কৃষি বার্তা

কৃষিকে পুষ্টির সঙ্গে যুক্ত করা প্রয়োজন

  প্রতিনিধি ৪ নভেম্বর ২০২৫ , ৫:৩৮:০০ প্রিন্ট সংস্করণ

বাংলাদেশ কৃষির দেশ। এ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে কৃষি। শস্য, ফলমূল, শাকসবজি, মাছচাষ, হাঁস-মুরগি পালন ও পশুপালন- সব মিলিয়ে আমরা খাদ্যোৎপাদনে অনেক দূর এগিয়ে গেছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সবার প্লেটে কি পুষ্টিকর ও সুষম খাবার উঠছে? এই কৃষির দেশে খাদ্য, সুষম খাবার ও পুষ্টির নিশ্চিত বর্তমানে বড্ড চ্যালেঞ্জিং। খাদ্যের প্রাচুর্য থাকলেও সুষম খাদ্য নিশ্চিত করাটা দুষ্কর। একজন পুষ্টিবিদ হিসেবে আমি বলব, খাদ্যের সহজলভ্যতা নিশ্চিত হলেও পুষ্টি নিরাপত্তা বা সুষম খাবারের নিশ্চয়তা এখনও আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

সুষম খাবার হলো এমন খাদ্য, যা শরীরের প্রয়োজনীয় সব পুষ্টি উপাদান, যেমন- কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, চর্বি, ভিটামিন, খনিজ লবণ ও পানি উপযুক্ত পরিমাণে সরবরাহ করে। এই উপাদানগুলো না থাকলে শরীরের স্বাভাবিক বৃদ্ধি, রোগ প্রতিরোধ এবং সুস্থ জীবনযাপন ব্যাহত হয়। সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতার জন্য প্রতিদিন পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য নিশ্চিত করা তাই খুব প্রয়োজন। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, এখনও অনেক শিশু, কিশোরী ও গর্ভবতী নারী অপুষ্টিতে ভুগছেন। আয়রনের ঘাটতি, ভিটামিনের অভাব, কম উচ্চতা ও ওজনজনিত সমস্যা সাধারণ চিত্র। শহর ও গ্রামে সচেতনতার অভাব, দারিদ্র্য এবং খাদ্যে ভেজালের কারণে পুষ্টির এই ঘাটতি ক্রমে আরও বাড়ছে। আমাদের দেশে চাল-ভাতভিত্তিক খাদ্যাভ্যাস অত্যন্ত প্রচলিত। অধিকাংশ মানুষ দিনের বড় একটি অংশে শুধু ভাত-ডাল বা একটা তরকারি খেয়ে থাকেন। মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ফলমূল কিংবা শাকসবজি যথেষ্ট পরিমাণে খাওয়ার প্রবণতা কম। ফলে খাদ্য থাকলেও তা সুষম হচ্ছে না। তাছাড়া শহরে আধুনিক জীবন-যাত্রার কারণে প্রক্রিয়াজাত, ফাস্টফুড ও অতিরিক্ত তেল-চর্বিযুক্ত খাবারের গ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করছে।

খাদ্যাভ্যাস ও পুষ্টির বর্তমান চিত্রটি এমন- বেশির ভাগ মানুষ সকালে শুধু চা-বিস্কুট বা চা-পরোটা খেয়ে দিন শুরু করেন। শিশুদের টিফিনে দেখা যায় চিপস, প্রসেস ফুড, ফাস্টফুড বা কৃত্রিম পানীয়। ফাস্টফুড ও জাঙ্কফুডের আধিক্য। শহুরে অঞ্চলে ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবারের অতিরিক্ত ব্যবহার শিশু-কিশোরদের মধ্যে পুষ্টির ভারসাম্যহীনতা বাড়াচ্ছে। এ অভ্যাসগুলো শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, খনিজ, ও ফাইবার সরবরাহে ব্যর্থ হয়। ফলে দেখা দেয় অপুষ্টি, অ্যানিমিয়া, দৃষ্টিশক্তির সমস্যা, এমনকি শিশুদের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়।

অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ ও কম প্রোটিন ও শাকসবজি গ্রহণ বেশি করে থাকে। অধিকাংশ পরিবারের খাদ্যতালিকায় চাল-ভাত, আলু ও অন্যান্য শস্যের আধিক্য থাকলেও মাছ, ডিম, দুধ ও শাক-সবজির পরিমাণ কম। ফলে প্রোটিনের ঘাটতি ও মাইক্রো নিউট্রিয়েন্ট অপুষ্টি দেখা দেয়।

অতিরিক্ত তেল বা সম্পৃক্ত চর্বি গ্রহণ বর্তমান স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ। আমাদের দেহের জন্য চর্বি বা ফ্যাটজাতীয় উপাদানের দরকার আছে সত্য, কিন্তু তা প্রতিটি খাবারের মধ্যেই কম-বেশি আছে। দেহের জন্য যতটুকু দরকার, তা দৈনিক রান্নায় অল্প ব্যবহার হলেই যথেষ্ট। অথচ প্রতিদিন আমরা বিভিন্ন খাবার তৈরিতে প্রচুর পরিমাণে তেল ব্যবহার করছি। সম্পৃক্ত চর্বি বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও রোজ লাল মাংস অধিক গ্রহণের করছি। এতে বাড়ছে স্থূলতা, লিভারের রোগ, উচ্চ রক্তচাপসহ হৃদরোগ ঝুঁকি। তাছাড়া নির্দিষ্ট কিছু ক্যানসার রোগের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। রোজ লাল মাংস খেলে শরীরে বিভিন্ন রোগ হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। একাধিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, লাল মাংস (গরু, মোষ, খাসি, ভেড়ার মাংস) অধিক গ্রহণের ফলে ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ও নির্দিষ্ট কিছু ক্যানসার রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাছাড়া সম্পৃক্ত চর্বি বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট (মাংস, দুধজাতীয় খাবার, চকোলেট, মার্জারিন, ক্র্যাকার্স, ফ্রেঞ্চফ্রাই, বেকারি সামগ্রী- কেক, বিস্কুট, ডানোট, প্যাস্ট্রি) স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতি। কেননা তা খারাপ কোলস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে।

কৃষি পণ্য ও খাদ্যে ভেজাল ও রাসায়নিকের প্রভাব। কৃষি পণ্য ও প্রক্রিয়াজাত খাবারে ভেজাল এবং অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের কারণে খাদ্যের নিরাপত্তা কমে যায়, যা পুষ্টির শোষণ প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করে।

দৈনিক সূর্যের আলো বা রোদ দাঁড়ানো সবাই ভুলেই গেছে। ভিটামিন-ডি স্বল্পতা বর্তমানে অনেক। দেহে ভিটামিন-ডি কমে গেলে রোগের প্রবণতা বেড়ে যায়। সূর্যের আলোর বিক্রিয়া, ফর্টিফাইড দুধ, সামুদ্রিক মাছ, ডিমের কুসুম, মাশরুম ইত্যাদি ভিটামিন ডি-এর অন্যতম উৎস। দারিদ্র্ ও নিম্ন আয়ের মানুষ পুষ্টিকর খাদ্য ক্রয়ে সীমাবদ্ধ। ফলে ম্যালনিউট্রিশন (অপুষ্টি) এবং অ্যানিমিয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশু ও নারীদের প্রতি অবহেলা কারণে অপুষ্টি ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ঘাটতি বাড়ছে। পরিবারে মেয়েদের খাবারে বৈচিত্র্য ও পরিমাণ কম, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্যও প্রভাবিত করে। শিশুদের মধ্যে আয়রন, জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন-এ’র ঘাটতি মারাত্মক হারে দেখা যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও খাদ্য ব্যবস্থার ঝুঁকি বাড়ছে। কৃষিপণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য না থাকলে খাদ্যতালিকাও সুষম হয় না। সুষম খাদ্য ও পুষ্টি নিশ্চিতে আমাদের যা করতে হবে তা হলোÑ খাদ্য পুষ্টি শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। ছোটবেলা থেকেই সুষম খাদ্য ও স্বাস্থ্যকর অভ্যাস শেখানো দরকার। স্কুল, কলেজ পুষ্টিবিষয়ক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কমিউনিটিতে পুষ্টি শিক্ষা সম্প্রসারণ করে শিশু, কিশোর ও গৃহিণীদের সচেতন করতে হবে সুষম খাবার সম্পর্কে। মাদ্রাসা ও মসজিদে সুষম খাবার ও পুষ্টি নিয়ে সচেতনতা মুলক বক্তব্য প্রদান করতে হবে, যা তারা এ সম্পর্কে সচেতন হন। গণমাধ্যমে বা মিডিয়ার মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। ঘরে ঘরে পুষ্টিবাগান তৈরি বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাড়ির আঙিনায় বা টবে শাকসবজি ও ফল চাষে উৎসাহ দিতে হবে। যেন পরিবারিক পর্যায়ে পুষ্টির ঘাটতি কমাতে সহায়ক হতে পারে। সুষম খাদ্যের সহজপ্রাপ্যতা বাড়াতে হবে। বাজারে পুষ্টিকর খাদ্য কম দামে সহজলভ্য করতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর পুষ্টি সহায়তা বাড়াতে হবে। ভর্তুকি দিয়ে দুধ, ডিম, সয়াবিন, লবণ, মাইক্রো নিউট্রিয়েন্টযুক্ত খাবার সহজলভ্য করতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা প্রদান করতে হবে। খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিতে পুষ্টিকর উপাদান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য সহজলভ্য করতে হবে সরকারি সহায়তা ও ভর্তুকির মাধ্যমে।

কৃষিকে পুষ্টির সঙ্গে যুক্ত করা একান্ত প্রয়োজন। শুধু খাদ্য উৎপাদন নয়, পুষ্টিমূল্য বিবেচনায় নিয়ে ফসল নির্বাচন করতে হবে। স্থানীয় কৃষিকে পুষ্টির সঙ্গে যুক্ত করা ও কৃষিপণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য আনতে হবে। কৃষিতে আমিষ ও ভিটামিনসমৃদ্ধ ফসলের উৎপাদন বাড়াতে হবে (ডাল, শাকসবজি, ফল, মৎস্য, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি)।

সবার জন্য ‘ফুড প্লেট গাইডলাইন’ অনুসরণ করা খুব প্রয়োজন। প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় পাঁচটি উপাদান থাকতে হবেÑ শস্য, প্রোটিন, সবজি, ফল ও দুগ্ধজাত পণ্য। স্থানীয় ও মৌসুমি খাবারের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। যেমনÑ কলা, লাউ-কুমড়া, শাক, সয়া, ডিম সহজলভ্য অথচ পুষ্টিকর। মনে রাখতে হবে, মৌসুমি ফলমূল ও শাকসবজি উক্ত মৌসুমের জন্য প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। নীতিনির্ধারকদের প্রতি আমাদের অনুরোধ থাকবে, খাদ্যনীতি প্রণয়নের সময় যেন পুষ্টি নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। প্রক্রিয়াজাত ও ফাস্ট ফুড নিয়ন্ত্রণসাপেক্ষে শিশু ও কিশোরদের প্রক্রিয়াজাত খাবারের বদলে স্থানীয় ও পুষ্টিকর খাবার অভ্যাস করানো উচিত। গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়ন করতে হবে। পুষ্টির দিক থেকে উন্নত জাতের ফসল, প্রোটিন বিকল্প, ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে হবে। খাদ্যে ভেজাল রোধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।

আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি নিরাপত্তা একসঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে। পুষ্টি একটি সমন্বিত বিষয়, যা খাদ্যের পরিমাণের পাশাপাশি তার গুণগত মানের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশে সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা এবং পুষ্টির ঘাটতি দূর করা হবে শুধু তখনই, যখন আমরা কৃষি উৎপাদনের পাশাপাশি খাদ্যের পুষ্টিমূল্য বাড়াতে সচেষ্ট হবো, পুষ্টি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেবো এবং সবার জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করব। এতে করে একটি সুস্থ ও শক্তিশালী জাতি গড়ে উঠবে। তাছাড়া সুস্থ থাকতে চাইলে প্রত্যেকেরই দিনে অন্তত দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা দৈহিক পরিশ্রম বা কাজ করা উচিত। দৈনিক কমপক্ষে ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটা। রাতের ঘুম ৭-৮ ঘণ্টা নিশ্চিত করতে হবে। দৈনিক পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে। দৈনিক সূর্যের আলোতে বা রোদে দাঁড়ানো আবশ্যক।

লেখক : পথ্য-পুষ্টিবিদ এবং সিনিয়র ডায়েটিশিয়ান ও

ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিস্ট এবং বিভাগীয় প্রধান

বিআরবি হসপিটালস লিমিটেড, ঢাকা

 

আরও খবর

Sponsered content